Sunday, February 3, 2019

ভারতের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সেক্যুলারদের ভণ্ডামি



সুমন দত্ত

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে শরণার্থী সমস্যা। এটি নতুন কোনো সমস্যা নয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে এই সমস্যা সংকট আকারে দেখা দিয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে মূলত গঠিত হয় জাতিসংঘ। যুদ্ধ নয় শান্তি এই স্লোগান এখন বিশ্ববাসীর। সব দেশেই শরণার্থীদের দেখা হয় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। মানবাধিকার হরণেই তারা হয়ে পড়ে শরণার্থী। এজন্য বিভিন্ন দেশ শরণার্থী গ্রহণে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। 
 
আজ বিশ্বে যে লক্ষ্য নিয়ে মানবাধিকার সনদ তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে চলছে বিতর্ক। বিভিন্ন দেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ সই করলেও তা বাস্তবায়নে অনীহা আছে দেশগুলোর।

সিরিয়া যুদ্ধে বহু মানুষ নিজ দেশে পরবাসী হয়। শরণার্থী হয়ে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে চায়। এতে আপত্তি জানায় ইউরোপের অধিকাংশ দেশ। কারণ ইউরোপের শিল্প উন্নত দেশগুলো খ্রিস্টান।

জার্মানি বাদে কোনো দেশই মুসলমান শরণার্থী রাখতে রাজি নয়। এসব দেশের নাগরিকদের মাঝে একটা ইসলামভীতি রয়েছে। আর বর্তমান সময়ে ইসলামের ইমেজটা বিশ্ববাসীর কাছে নেতিবাচক। তাছাড়া শত বছর ধরে চলা খ্রিস্টান-মুসলমান যুদ্ধের (ক্রুসেডের) স্মৃতি তাদের বই পুস্তকে লেখা আছে। তাই আধুনিক ভাবনার হলেও তারা সিরিয়ার মুসলমান শরণার্থী গ্রহণে রাজি নয়। জার্মানি সিরিয় শরণার্থী গ্রহণের ঘোষণা দিলেও দেশটির ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো মুসলমান শরণার্থী গ্রহণে আপত্তি জানিয়েছে।

বাংলাদেশে রয়েছে বিহারী ও রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিহারিদের বলা হয় আটকে পড়া পাকিস্তানি। অন্যদিকে পাকিস্তানে এই বিহারিদের পরিচয় মোহাজির হিসেবে। এদের ভাষা উর্দু। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ তৈরি হলে গরিব অনগ্রসর বিহারীরা বাংলাদেশে রয়ে যায়। পাকিস্তান তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নেবার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ পর্যন্ত তারা সেটা বাস্তবায়ন করেনি।

পাকিস্তানের সিন্ধুতে বিহারীদের জন্য জায়গা বরাদ্দ হয়। কিন্তু তাদেরকে সেখানে পুনর্বাসন করে হয়নি। যার ফলে বিহারিরা বাংলাদেশে থেকে যায়। এদের জন্য জাতিসংঘ  বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্প তৈরি করে। সেখানে এদের আশ্রয় হয়। ঢাকার মোহাম্মদপুরে এখনো বিহারীদের জেনেভা ক্যাম্প রয়েছে।


সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার আইন সংশোধন করে এদেশে জন্ম নেয়া বিহারীদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দিয়েছে। অনেকে আবার এই সুযোগ গ্রহণ না করে এখনো পাকিস্তানে ফিরে যাবার আশায় আছে। এই আইন সংশোধনের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে দেশের সংবাদ পত্র ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। বিহারিদের দু:খ কষ্টের কথা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করলে সরকার এদেরকে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেয়। 

 প্রসঙ্গত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলাকালে এদেশে যতগুলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিল বিহারী মুসলমানরা। এদের সঙ্গে ওসব দাঙ্গায় অংশ নিয়েছিল এদেশের কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। যাদের মধ্যে জামাতি ও মুসলিমলীগপন্থি লোকরা ছিল। এদের অত্যাচারের কারণে বহু হিন্দু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে যায়। বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়ে।  প্রথমে এরা শরণার্থী হয়, পরে ভারত সরকার একটি ঘোষণার মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব দেয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের সেই যাওয়া এখনো চলছে। তবে নীরবে।

বাংলাদেশ সরকার অনেকটা অসহায় হয়ে বিহারী মুসলমানদের এদেশের নাগরিক করে নেয়। এতে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা গোষ্ঠী সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেনি। অথচ এই বিহারী জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল। রোহিঙ্গা সংকটেও বাংলাদেশ ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলছে। মুসলমান হওয়ার কারণে সরকার এদের পুনর্বাসন করার জন্য কয়েকটি চরাঞ্চল ঠিক করেছে। এসব রোহিঙ্গা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনা এদেরকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আশ্রয় দিয়েছে। অতীতে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এদেশের সুনাম নষ্ট করেছে। এসব ক্রিমিনাল রেকর্ড জানার পরও শেখ হাসিনা সরকার রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। যা ভারতের সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের কাছে শিক্ষণীয় হতে পারে। শরণার্থীদের প্রতি সবার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত।

 আজ ভারতীয় সমাজে সেই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি কোথায়? হীন রাজনীতির স্বার্থে মানবিকতাকে বলি দিল ভারতীয় রাজনীতিবিদদের একটি বৃহৎ অংশ।  আর সেটি জানা যায় সম্প্রতি ভারত সরকার প্রতিবেশী দেশের অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিক করে নেবার ঘোষণায়। নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছে ভারতের প্রধান রাজনৈতিক পার্টি কংগ্রেসসহ দেশটির আঞ্চলিক দলগুলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এক কালে যেই কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কোটি কোটি হিন্দুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দিয়েছে আজ তারাই এই আইনের বিরোধিতা করছে। পাশাপাশি বিজেপির ব্যানারে যারা নির্বাচিত হয়েছে তাদের অনেকেই এই আইনের বিরোধ জানায়।

 নাগরিকত্ব আইন লোকসভায় পাস হওয়ায় উত্তর পূর্ব ভারতের লোকজনদের বোঝানো হচ্ছে বাংলাদেশের সব হিন্দু তাদের অঞ্চল দখল করে ফেলবে। বাংলাদেশের হিন্দুরা যে ওই সব পাহার পর্বত বেষ্টিত এলাকায় যেতে আগ্রহী নয় সেটা জানার কিংবা বোঝার চেষ্টা করছে না কেউ। এদিকে প্রচার করা হচ্ছে উত্তর পূর্ব ভারতের সংস্কৃতি নষ্ট করে দেবে এই আইন। কারা কিভাবে এটা করবে সেই ব্যাখ্যায় যাচ্ছে না কেউ। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে এ এক আজব প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। 

কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলগুলো নিজেদের সেক্যুলার রাজনীতির ধারক ও বাহক বললেও এই বিলের বিরোধিতার মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক ভণ্ডামি প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসেছে। তাদের মতে বিজেপি সরকারের এই বিল সাম্প্রদায়িক, নিজেদের পক্ষে ভোট টানার জন্য এই বিল লোকসভায় পাস করানো হয়েছে। সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এই বিল পাশ না হওয়া পর্যন্ত এটি আইনে পরিণত হবে না। আর রাজ্যসভায় বিজেপি সরকারের কোনো মেজরিটি নেই। তাই এই বিল রাজনৈতিক চমক হিসেবে থেকে যাবে। এর থেকে কোনো সমাধান মিলবে না। 

 প্রকৃতপক্ষে বিলটি হচ্ছে সেক্যুলার। বিলে আছে বাংলাদেশ,পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে অমুসলিমরা নির্যাতনের শিকার হলে তারা ভারতে আশ্রয় নিতে পারবে। টানা ৬ বছর ভারতে থাকলে তারা  দেশটির নাগরিক হতে পারবে। কারণ সবাই জানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ,পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে অমুসলিমরা (হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-শিখ ও জৈনরা) নিপীড়নের শিকার।  তারপরও নিপীড়িত এসব মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে তথাকথিত এসব সেক্যুলার রাজনৈতিক দল। আজ ভারতে যেসব নির্যাতিত হিন্দু বাস করছে তাদের অতীতে কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। তারা শান্তি প্রিয় হিন্দু।

এই বিলের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানরা হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও শান্তি প্রিয় শরণার্থী হিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব দিতে তাদের অনীহা। যেখানে বাংলাদেশ সরকার দেশটির গণহত্যায় অংশ নেয়া বিহারী জনগোষ্ঠীকে উদার মনে নাগরিকত্ব দেয়। ভারতে তার উল্টোটা দেখতে পাওয়া যায়।

 মমতা, লালু প্রসাদ ও রাহুল গান্ধিরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অথচ তাদের উচিত ছিল নিপীড়িত শরণার্থী হিন্দুদের পাশে দাঁড়ানো। আবার এরাই দুর্গা পূজা এলে আমি হিন্দু  বলে প্রচার করে।  ভোটের আশায় রাহুল শিব মন্দিরে ঘোরাঘুরি করে। শিবের পূজা দেয়। লালু প্রসাদের বউ বাড়ির সুইমিং পুলে নেমে সূর্য পূজা দেয়ার ছবি লাইভ দেখায়। অথচ নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে তারা দাঁড়াতে চায় না। তাদেরকে নাগরিকত্ব দিতে চায় না। এ এক আজব ভণ্ডামি ভারতীয় রাজনীতিবিদদের।

No comments:

Post a Comment