বিএনপি সম্পর্কে ভারতের অবস্থান বদল হবে কি?
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার নির্দেশে দলটির তিন জ্যেষ্ঠ নেতার ভারত সফর ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগে এ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ভারত যে একটা ফ্যাক্টর তা বিএনপি নেতাদের এই সফরের মধ্য দিয়ে নতুন করে প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশ ও ভারতের মিডিয়াগুলো বিএনপিকে পাকিস্তান ঘেঁষা পার্টি হিসেবে মনে করে থাকে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট করা এ দাবিকে আরও হাওয়া দেয়। তাই বিএনপিকে ভরসা করতে পারে না ভারতের কোনো রাজনৈতিক দল। ভারত বার বারই বিএনপির কাছে জানতে চেয়েছে জামায়াত বিএনপি ভিতর কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী। মানে জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা কতটা। কারণ জামায়াত নিয়ন্ত্রিত হয় ইসলামাবাদ থেকে।
বাংলাদেশে জামায়েতে ইসলামির নিজস্ব কোনো রাজনীতি নেই। এরা চলে পাকিস্তানের কথায়। আর বাংলাদেশে ভারত বিরোধী প্রচারণা করে থাকে এই রাজনৈতিক দলটি। তাই এই ট্রেডমার্ক ভারত বিরোধী শক্তিটির সম্পর্ক বিএনপির সঙ্গে কেমন, সেটি দিয়ে তারা পাকিস্তানের এজেন্ডা জানার চেষ্টা করে। তবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে খালেদা জিয়া পর্যন্ত কেউ ভারত বিরোধী পলিসি নিয়েছেন এমনটা অতীত ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায়নি।
বিএনপি বাংলাদেশে ভারত বিরোধী রাজনীতি করেছে ঠিকই। কিন্তু কর্ম ক্ষেত্রে ভারত বিরোধিতা তারা দেখাতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইন্দিরা মুজিবের ২৫ বছর শান্তি চুক্তি। এই চুক্তিকে বিএনপিপন্থিরা গোলামীর চুক্তি বলে মন্তব্য করে। কিন্তু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়নি বাংলাদেশ। এই চুক্তিকে জিয়া-খালেদা মান্যতা দিয়ে টিকিয়ে রাখে। চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবার শর্ত থাকা সত্ত্বেও জিয়া-খালেদা এই চুক্তিকে বহাল রেখেছে। অন্যদিকে এই চুক্তিকে গোলামীর চুক্তি বলে বাংলাদেশে বিএনপি ও সমমনারা ভারত বিরোধী রাজনীতি করে গেছে।
জাতিসংঘে খালেদা জিয়া বহুবার ফারাক্কা নিয়ে ভারত বিরোধী হন। আর ভারত গিয়ে তিনি ফারাক্কা নিয়ে কথা বলতেই ভুলে যান। বিএনপি যে সত্যিই কোনো সময় ভারত বিরোধী ছিল না এসব অতীত কর্মকাণ্ড তাই প্রমাণ করে। তারা মুখেই ভারত বিরোধী রাজনীতি করে গেছে কার্যক্ষেত্রে নয়।
তবে এটা সত্য বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এদেশে পাকিস্তানপন্থীদের দৌড়াত্ম বেড়ে যায়। আর তারই খেসারত দিচ্ছে বিএনপি। ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতাদের গ্রেনেড দিয়ে হত্যা করা। বাম সংগঠনগুলোর ওপর সিরিজ বোমা হামলা, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, চার্চে বোমা হামলা, বিএনপির রাজনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিল বিএনপির মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা পাকিস্তানপন্থীরা।
তাছাড়া ভারত বিরোধী শক্তিগুলোকে মদদ দেয়ার জন্য ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরার পড়ার ঘটনাটাও বিএনপির জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এসব কর্মকাণ্ডে প্রতিবেশী ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে তা হাড়ে হাড়ে একজনই টের পাবেন। আর সেই তিনি হচ্ছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারত, চীন এদেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে খুবই সচেতন। এদের কোনো একটি দেশ যদি জঙ্গিবাদের শিকার হয়, নিরাপত্তার খাতিরে তারা একজোট হয়ে সেই সংগঠনকে বয়কট করে। এমন চুক্তি দেশগুলোর সঙ্গে রয়েছে। বিএনপি আজ দুর্বল জামায়াতের মত একটি উগ্র সংগঠনকে নিজেদের ঘাড়ে তুলে রাখার জন্য। বিএনপি থেকে যতই বলা হোক এটা ভোটের জোট, নীতি আদর্শের জোট নয়। তারপরও বিদেশি শক্তিগুলো কখনই বিএনপিকে বিশ্বাস করবে না। জামায়েতকে বগলে রেখে বিএনপি কোনো দাবিই পূরণ করতে পারবে না।
বিএনপিকে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে জামায়েতকে ছাড়তে হবে। অন্তত ভারতের আস্থা অর্জন করতে হলে বিএনপিকে সেটাই করতে হবে। বিএনপিকে বুঝতে হবে এরশাদ এদেশে হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা করেও ভারতের সমর্থন পায়। কারণ এরশাদ ভারত বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না। এদেশের হিন্দুদের জন্য ভারতের কোনো কালেই মাথা ব্যথা ছিল না, এখনও নেই। তবে কোনো কোনো হিন্দু মনে করতে পারে ভারতের মাথা ব্যথা আছে। সুতরাং বিএনপি ২০০১ সালে নির্বাচনে জিতে খুলনায় কয়েকটা হিন্দু মারাল। আর আগুন দিয়ে হিন্দুর ঘর পোড়ানোর হুলিয়া মাথায় নিয়েও ভারতের সমর্থন পেতে পারে যদি তারা ভারত বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হয়। যেটা আওয়ামী লীগ বিগত ১০ বছর করে দেখিয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনে কত মন্দির ভাঙ্গা হলো, হিন্দুদের ঘর পোড়ানো হল। তারপরও ভারতের সমর্থন পেয়ে যাচ্ছে। এমনকি নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদী সমর্থন। এর একটাই কারণ, শেখ হাসিনা ভারত বিরোধী শক্তিদের আশ্রয় দেয় না।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়া ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চান। এটা তার ভালো উপলব্ধি। সেটা নিয়ে তিনি হোম ওয়ার্ক ভালই করছেন। সেটা বোঝা গেছে ভারতের বিভিন্ন থিংক ট্যাংকের সঙ্গে তার প্রতিনিধিদের পাঠিয়ে। তিনি চেষ্টা করছেন বিএনপি সম্পর্কে ভারতের যে ধারণা তৈরি হয়েছে সেটি ভুল। অতীতের ভুল রাজনীতির শিকার তার দল। তিনি এবার দলের হয়ে নতুন ধারার রাজনীতি করতে চান। যেখানে বাংলাদেশে থাকবে না কোনো জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত বিরোধী কর্মকাণ্ড। আগামীতে হয়ত বিএনপি ভারতে আরো প্রতিনিধি পাঠাবে। তেমন ইঙ্গিতই মিলছে তার এই প্রতিনিধি দলের সফরের মধ্য দিয়ে।
বিএনপির প্রবীণ অনেক রাজনীতিবিদ ছিলেন, যারা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তার মধ্যে ছিলেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। তিনি আজ নেই। বিএনপির উচিত দলের সেই সব রাজনীতিবিদকে কাজে লাগানো। যদিও প্রবীণদের সঙ্গে তারেক জিয়ার সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। আছে মতবিরোধ। দলের খাতিরে তারেক জিয়াকে তাদের ব্যবহার করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় ভারত যেসব বিএনপি নেতার ওপর আস্থা রাখে তাদের নিয়ে তারেক জিয়া সরাসরি দিল্লি কিংবা অন্যকোনো স্থানে বৈঠক করুক। এতে ভারতের সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। সহজ হবে আওয়ামী লীগসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো আগামীতে কীভাবে নির্বাচন করবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে। যেটা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরী।
No comments