বিচারপতি সিনহাকে নিয়ে বিতর্ক কতটুকু সত্য ?
৯০ এ স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসে। টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ) বিএনপি সরকারের ওপর প্রতিবেদন পেশ করে। তখন টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান। পর পর তিন বছর বিএনপিকে বিশ্বের চ্যাম্পিয়ান দুর্নীতিবাজ ঘোষণা করে টিআইবি। আর একে পুঁজি করে আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপির প্রতি বিষদগার করতে থাকে। আওয়ামী লীগপন্থি সাংবাদিকরা লিখতে থাকে বিশেষ কলাম।
এরপর ১৯৯৬ তে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে টিআইবির বাংলাদেশকে নিয়ে করা দুর্নীতি সূচক খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। অন্যদেশ বেশি দুর্নীতি করায় বাংলাদেশের নাম কয়েকধাপ নিচে নেমে যায়। এবার টিআইবির ওপর ক্ষুব্ধ হয় আওয়ামী লীগ ও তার বুদ্ধিজীবীরা।সততায় ঘাটতি থাকায় টিআইবির বিরুদ্ধে তারা কোনো অ্যাকশনে যায় না। আর একেই পুজি করে বিএনপি। যারা এতদিন টিআইবির রিপোর্টের বিরোধিতা করেছিল। তারা তখন টিআইবির রিপোর্টের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকে। এরপর ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। টিআইবিও যথারীতি প্রতিবেদন দিতে থাকে।
ওয়ান এলিবেনে সরকার পরির্বতন হলে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। অনেকটা অহংকার নিয়ে নিজেদের সাধু পরিচয় দিতে থাকে এই সরকার। টিআইবি এবার সেক্টর ভিত্তিক দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে। অথাৎ বাংলাদেশ সরকারের কোন খাত সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ তার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে সংস্থাটি। একবার টিআইবি থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ হলো দেশের বিচার বিভাগ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ। বিচার বিভাগের চেয়ার টেবিলও ঘুষ খায়।
এই প্রতিবেদন যখন প্রকাশ হয় তখন সুপ্রিমকোর্ট ক্ষুব্ধ হয়। তারা টিআইবির বিরুদ্ধে সুয়োমোটো রুল জারি করে। টিআইবিকে দেখে নেবার হুমকি এমন একটা ভাব। তখন হাইকোর্ট ডিভিশনের রীট কোর্টের বিচারপতি ছিলেন সামসুদ্দিন চৌধুরি মানিক ও আপীল বিভাগের প্রধান বিচারপতি ছিলেন খায়রুল হক।
সেদিন বিচারপতি মানিক টিআইবিকে নানা প্রশ্ন করে। কিন্তু কিছুতেই তিনি প্রমাণ করতে পারেন না টিআইবি ভুল। টিআইবি তাদের সমস্ত তথ্য সিডি আকারে জমা দেয় বিচারপতি মানিকের দ্বৈত বেঞ্জে। এরপর হাইকোর্ট সেখানেই থেমে যায়। এ নিয়ে আর বেশি বাড়াবাড়ি করেনি। হাইকোর্ট টিআইবির রিপোর্ট মেনে নেয়। কারণ টিআইবি হাইকোর্টে এসবের জন্য কোনো ক্ষমা চায়নি।
এখন দুর্নীতিগ্রস্থ সেই হাইকোর্টের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা একজন দুর্নীতিবাজ বিচারপতি। তার বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া আছে নারী কেলেঙ্কারি। এসব অভিযোগই আসে তখন যখন বিচারপতি সিনহা যোড়শ সংশোধনীতে বিচারপতিদের বিচারের দায়িত্ব সাংসদের ওপর ছেড়ে দেবার প্রস্তাব বাতিল করে দেন।
আওয়ামী লীগ থেকে তাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। তিনি তা না করলে তাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। অবশেষে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে সেখান থেকে পদত্যাগপত্র সংগ্রহ করে সরকার। এরপর কেটে গেছে অনেক দিন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করেনি সরকারের কোনো সংস্থা। হঠাৎ তিনি ব্রোকেন ড্রিম নামে একটি বই লিখলেন আর শুরু হলো তাকে নিয়ে আবার হইচই। শুরু হলো লোক দেখানো সরকারি তদন্ত। তিনি কোন ব্যাংক থেকে কত টাকা পে অর্ডারের মাধ্যমে নিলেন তার হিসাব ইত্যাদি।
এদিকে সরকারের চামচা দালাল সাংবাদিকরা সিনহাকে নিয়ে আবার লেখালেখি শুরু করলেন। বোঝাতে চেষ্টা করলেন তিনি একজন দুর্নীতিবাজ। তাকে নিয়ে মুখোরোচক গল্প। বিচারপতি সিনহা সম্পর্কে সরকার এখন পর্যন্ত কিছু করতে পারেনি। করে দেখালে জাতি উপকৃত হতো।
বিচারপতি সিনহাকে প্রধান বিচারপতি বানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। মানে শেখ হাসিনার সুপারিশে রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপীল বিভাগে নিয়োগ দেন। তাকে প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত করার কারণ হিসেবে সরকারের চামচা মিডিয়া থেকে বলা হলো তিনি হিন্দু এ কারণে তাকে বিচারপতি করা হয়েছে। তার ধর্মীয় পরিচয় এখানে কাজ করেছে। এরপর আরো খবর এলো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পদেও হিন্দুদের স্থান দেয়া হবে। শেখ হাসিনার ছেলে জয় নাকি এমন মন্তব্য করেছেন।
বাংলাদেশের হিন্দুরা এসব শুনে খুশি হয়েছিল। আওয়ামী সমর্থিত হিন্দুরা লুঙ্গি তুলে নেচেছিল। আর এখন সেই তারাই সিনহার হিন্দু পরিচয় না দিয়ে তিনি নৃগোষ্ঠী-উপজাতি তার এসব পরিচয় সামনে টেনে আনছেন। এদেশের সাংবাদিকরা রাজনীতিবিদদের মত ডিগবাজি খেতে ওস্তাদ।
বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে কয়টা অভিযোগ? কি কি? সাংবাদিকদের তাৎক্ষনিক এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি কেউ। তবে আপীল আদালতে তার সঙ্গে কাজ করা এক বিচারপতি কয়েকটি অভিযোগ মিডিয়াতে বলেন। তার মধ্যে একটি অভিযোগ ছিল বিচারপতি সিনহার নারী কেলেঙ্কারি সম্পর্কে। এর অডিও ভিডিও নাকি সরকারের কাছে আছে। হয়ত সরকার এসব দেখবে। এই আশায় থাকলাম।
সর্বোচ্চ আদালতে কত নারী কাজ করে। আপীল বিভাগে সিনহার সঙ্গে এক নারী বিচারপতিও ছিল। কই তাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ তো শুনলাম না। সম্মানের সঙ্গে সেই নারী বিচারপতি অবসর নিলেন। তাহলে কোন নারীর সঙ্গে সিনহা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন। জাতি জানতে চায়।
বিচারপতি এস কে সিনহা নিয়ে বিতর্কের শুরু এক অডিও টেপ ঘিরে। এই অডিও টেপ সবার নজর এড়িয়ে চলে যায় এসি রুমে বসা এক নির্বাহী সম্পাদকের ঘরে। যিনি প্রধানমন্ত্রী সফর সঙ্গী হয়ে বেশ কয়েকবার বিদেশ যান। সরকারের দালালি করে সেরা সাংবাদিকতার পুরস্কার বাগিয়ে নেন। বাংলাদেশে ওই সম্পাদকের পত্রিকা সরকার পক্ষের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত। অনেকে ওই পত্রিকাকে টয়লেট পেপারের সঙ্গে তুলনা করে। ওই পত্রিকার মলিক মুজিব সৈনিক আর তার ভাই জিয়া সৈনিক।
সেই পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সাহেব অডিও শুনিয়া মনের মাধুরি মিশাইয়া দালালি মার্কা একটি কলাম লেখেন। যেখানে তিনি দাবি করেন যুদ্ধাপরাধীর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতে চায় বিচারপতি সিনহা। সেই সাক্ষাৎ আটকাতে হয় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। লেখার ইংগিতটা এমন যে সাক্ষাৎ হলে সিনহাবাবু এক বস্তা টাকা পেতেন আর রাজাকারদের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কিংবা খালাস এমন কিছু সাজা দিয়ে দিতেন।
এই রিপোর্ট চ্যালেঞ্জ করেন প্রধান বিচারপতি সিনহা।পরে ওই পত্রিকার মালিক ও নির্বাহী সম্পাদককে আদালতে তলব করা হয়। আদালতে তারা সিনহার অডিও টেপ শোনান। এতে সিনহা স্বীকার করেন এই গলা তার। এখন প্রশ্ন এতে কি প্রমাণ হয় সিনহা দুর্নীতি করেছেন কি করেননি? এই প্রশ্নের উত্তর আমি পাঠকের কাছেই রাখলাম।
প্রসঙ্গত এ ঘটনা এমন এক সময় ঘটল যখন প্রধানমন্ত্রীর সেবাদাস এক বিচারপতি আপীল বিভাগে প্রমোশন পেলেন। তার নিয়োগের আগে বিচারপতি সিনহাকে নিয়ে আপীল আদালতে কেউ কোনো কিছু বলেছে কি না আমার জানা নেই। আমি কখনও বিচারপতি সিনহাকে নিয়ে বিতর্ক শুনিনি।
বরং যুদ্ধাপরধীদের বিচার নিয়ে বিতর্কে চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দেন বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম। তার বিরুদ্ধে স্কাইপি কেলেঙ্কারি ফাঁস করে অজ্ঞাত সূত্র। উল্লেখ্য সিনহার অডিও টেপও ওই অজ্ঞাত সূত্র প্রকাশ করে। তবে দুই বিতর্কের ফল ভিন্ন। একজন বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন। আরেকজন ট্রাইব্যুনাল ছেড়ে হাইকোর্টের বিচারপতির কাজে ফিরে যান। সম্মানের সঙ্গে অবসর নেন। যেটা হওয়া উচিত ছিল এস কে সিনহার ক্ষেত্রেও।
অবসরের কিছুদিন আগে তাকে অপমানিত করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ এস কে সিনহা চেষ্টা করেছিলেন বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে মিটিয়ে ফেলতে। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমন এক নারী যিনি নির্বাচনের আগে হিজরাদের সঙ্গে ছবি তুলেন, কথা বলেন। অথচ দেশের প্রধান বিচারপতির মুখ দেখতে চান না। আজব এক নারী।
যারা সিনহাকে দুর্নীতিবাজ বলছেন, তাদের কাছে আমি বলতে চাই। সিনহা যদি দুর্নীতিবাজ হয় তবে ঘুষ খেয়ে তিনি কেন হাজার কোটি টাকার মালিক মীর কাশেমকে খালাস দিলেন না? কেন সাকাসহ অন্যদের ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দিলেন ?
অন্যদিকে সিনহার পর প্রধান বিচারপতি হলেন এম এ ওহাব। তিনি তো কোনো রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ডই দেননি বলেই জানি। তার নামে কোনো বিতর্ক নেই কেন? তিনি নাকি অন্য বিচারপতিদের নিয়ে এস কে সিনহার বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন। সেটা নাকি সিনহার দুর্নীতির জন্য? পরে সিনহার বইতে জানা গেল এই ঘটনা মিথ্যা। তাহলে কি দাড়ালো ? সিনহাকে নিয়ে মিথ্যাচার হয়েছে।এখন প্রশ্ন, কাদের বাচাতে বিচারপতি সিনহাকে অবসরে যাবার আগে পদত্যাগ করতে হলো? এটা জাতির জানা জরুরী। তা না হলে এটা বিচার বিভাগের কলঙ্ক হিসেবে টিকে থাকবে।
বিচারপতিদের বিচার ওই সংসদে হওয়া উচিত যেখানে একজন সংসদ সদস্য স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে। যে সংসদে একজন সংসদ সদস্য তার দলের বিরুদ্ধে কথা বললে সদস্যপদ চলে যায়। সেখানে বিচারপতির বিচার মানায় না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ জাতীয় সংসদকে দলের নেত্রীর চাকরে পরিণত করেছে। সুতরাং ওই চাকর মার্কা সংসদে বিচারপতির বিচার চলে না। ওই ক্ষমতা সেখানে গেলে দেখা যাবে শেখ হাসিনা যা বলবে টেবিল থাপরিয়ে সেটাই কার্যকর করবে তার দলের সংসদ সদস্যরা। তখন বিচারবিভাগের বিচারপতিরা শেখ হাসিনার আতঙ্কে থাকবে। কখন চাকরিটা চলে যায় এই আতঙ্কে ঠিক মত রায় দিতে পারবে না। এখন যাও আছে ওই সময় সেটাও থাকবে না। তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থে বিচারপতিদের বিচার আপীল বিভাগেরই থাকা উচিত।যেটা এখন বর্তমানে আছে।
আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমন এক নারী যিনি নির্বাচনের আগে হিজরাদের সঙ্গে ছবি তুলেন, কথা বলেন। অথচ দেশের প্রধান বিচারপতির মুখ দেখতে চান না। আজব এক নারী। !!!!!!!!
ReplyDelete