যে কারণে কাশ্মীর হচ্ছে তিন টুকরা
ভারতবর্ষ ভাগের ক্ষত নিয়ে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের
মাঝে বেঁচে আছে কাশ্মীর।
রাজনীতি
চিরকাল এক রকম থাকে না। রাজনীতির সঙ্গে দেশের অর্থনীতিও পাল্টায়। ভারতের কাশ্মীর পলিসি
চিরকাল যে একরকম থাকবে তেমনটা নয়।
কাশ্মীর ছিল রাজা শাসিত অঞ্চল। রাজার কথাই ছিল শেষ কথা। দেশ ভাগের সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল রাজা
শাসিত অঞ্চলে রাজা যেখানে যোগদান করবে সেদিকে যাবে ওই অঞ্চল। তেমনি ত্রিপুরার রাজা
ভারতে যোগ দেয় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের অনেক পরে। লাক্ষাদ্বীপ,গোয়া এগুলো ভারত
স্বাধীনের পর যোগহয়।
১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের রাজা হরি সিং ভারত পাকিস্তানের
কোনো অঞ্চলে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ তিনি হিন্দু হলেও তার প্রজারা ছিল মুসলমান।
ভারতে যোগ দিলে প্রজারা বিদ্রোহ করবে এমন ভাবনা থেকেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
আর সেটা নেয়ার পিছনে যুক্তিও ছিল। কারণ তখন ভারতের হায়দ্রাবাদ ছিল নিজামের শাসনে।
নিজাম
পাকিস্তানে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিলে সেখানকার হিন্দুরা বিদ্রোহ করে। নিজামে হিন্দু প্রজারা
ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। পরে নিজাম তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
এদিকে পাকিস্তান ধরে নিয়েছিল কাশ্মীর তাদের
হচ্ছে। পাকিস্তান যখন দেখল কাশ্মীর তাদের হাত ছাড়া হবার পথে। তখন তারা কাশ্মীরে আক্রমণ
করে বসে। কাশ্মীরের প্রতিবেশী পাকিস্তানের গ্রামগুলো থেকে লোকজনকে সেখানে সরিয়ে নিয়ে
আসে।
এমন এক অবস্থায় কাশ্মীরের রাজা ভারতে যুক্ত হবার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ভারতের সেনারা
গিয়ে পাকিস্তানের অনুপ্রবেশ ঠেকায়। যেখানে এই অনুপ্রবেশ থামে সেখান থেকেই শুরু হয় লাইন
অব কন্ট্রোল। তবে এই লাইন অব কন্ট্রোল স্বীকৃতি পায় তাসখন্দ চুক্তিতে। ভারত পাকিস্তান
দ্বিতীয় কাশ্মীর যুদ্ধে।
ভারতে যুক্ত হবার পর রাজার এই সিদ্ধান্ত কাশ্মীরের
বহু লোকজন মন থেকে আজও মেনে নেয়নি। তারই প্রতিফলন ঘটে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দু পণ্ডিতদের
তাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে। এক সময় কাশ্মীরে বহু হিন্দু পরিবার ছিল। দেশ ভাগের পর সেখানে
আর একটি পরিবারও নেই।
বাংলাদেশে
হিন্দু উচ্ছেদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে রাজনীতি করে। কাশ্মীরেও হিন্দু উচ্ছেদে একই
রাজনীতি করে সেখানকার পিডিপি ও ন্যাশনাল কনফারেন্স। হিন্দুরা গণহত্যার শিকার হলে পিডিপি
দোষ চাপায় ন্যাশনাল কনফারেন্সের ওপর। আর ন্যাশনাল কনফারেন্স দোষ চাপায় পিডিপির ওপর।
মাঝখান থেকে এসব হত্যাকাণ্ডের আর কোনো বিচার হয় না। এভাবে একটা সময় কাশ্মীরের হিন্দুরা
সেখানকার হিন্দু প্রধান অঞ্চল জম্মুতে আসতে শুরু করে। কাশ্মীর থেকে উচ্ছেদ হওয়া হিন্দুরাই জম্মুর
প্রধান বাসিন্দা। সেখানে তারা ব্যবসা বাণিজ্য করে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরআগে কাশ্মীর যখন ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়, তখন শেখ
আবদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি আন্দোলন চলছিল। কাশ্মীরের মানুষের অধিকার রক্ষার সেই আন্দোলনে
সমর্থন জানায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। কাশ্মীরের লোকজনের সহায় সম্পত্তি
কেড়ে নেয়া হবে না। রাজ্যকে বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। এমন শর্তে শেখ আবদুল্লাহর ওই আন্দোলন
থামে। এরই ফলশ্রুতিতে ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। ৩৫ অনুচ্ছেদ
অনুসারে ভারতের অন্য রাজ্যের কেউ কাশ্মীরে গিয়ে জমি কিনতে পারবে না। আর ৩৭০ অনুচ্ছেদ
অনুসারে কাশ্মীরে লোকজন সস্তায় ধান, চাল, ডাল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য,
বিদ্যুৎ সবকিছু পাবে। অন্য রাজ্য এতে আপত্তি জানাতে পারবে না। এই শেখ আবদুল্লাহর
ছেলেই বর্তমানে ফারুক আবদুল্লাহ। যিনি ন্যাশনাল কনফারেন্সের রাজনীতি করেন পরে ভারতের
বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টির আনুকূল্য পান।
অন্যদিকে১৯৫০
এর দশকে ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে গোলাম মহম্মদ সাদিক বেরিয়ে গিয়ে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল
কনফারেন্স পার্টি হয়।এই পার্টির হাত ধরে মুফতি মহম্মদ সাইদ রাজনীতি শুরু করেন। পরে
১৯৬৫ সালে ন্যাশনাল কনফারেন্স ভারতের জাতীয় কংগ্রেস পার্টিতে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর
মুফতি সাইদ বহু পার্টির হাত গুরে ১৯৯৮ সালে পিডিপি গঠন করে। কাশ্মীরে এই রাজনীতিবিদরা
ভারতের কেন্দ্র সরকারে যখন যে ক্ষমতায় ছিল তখন তার হাত ধরে রাজনীতি করে গেছে। মন্ত্রী
এমপি হয়েছে। ক্ষমতার হালুয়া রুটি খেয়েছে। এখন এদের বংশধররা একই কৌশলে কাশ্মীরে রাজনীতি
করছে।
বর্তমানে ভারতের ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। যারা
কাশ্মীরের পুরো বিষয়টি অন্যভাবে দেখে। তাদের ভাবনা শুধু এই কাশ্মীর ঘিরে নয়। পাকিস্তানের
হাতে থাকা কাশ্মীরকে তারা নিজের মনে করে। সেটিকে ফিরিয়ে আনার এজেন্ডা তাদের রাজনীতির
মধ্যে আছে। এমন একটি শক্তির সঙ্গে কাশ্মীরের বর্তমান রাজনৈতিক অস্তিত্ব যে টানাপড়েনের
মধ্যে পড়বে সেটা বলাই বাহুল্যে।
জম্মুতে বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল
বিজেপি। কিছুদিন আগে তারা পিডিপির সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় ছিল। হঠাৎ বিভিন্ন ইস্যুতে
তাদের সেই জোট ভেঙ্গে যায়। এর মধ্যে তাদের একটি ইস্যু ছিল কাশ্মীরের হিন্দুদের উপত্যকায়
ফিরে নিতে হবে। এজন্য আলাদা একটি অঞ্চল তাদের দিতে হবে। এই দাবি মানতে রাজি নয় মেহবুবা
মুফতি এমনকি কাশ্মীরের অন্য রাজনৈতিক দলগুলো।
তারা চায় হিন্দুরা যে যেভাবে যেদিকে ছিল সেভাবেই ফিরবে। আর এতে রাজি ছিলনা বিজেপি নেতৃত্ব।কারণ
হিন্দুরা বিচ্ছিন্নভাবে থাকলে তারা পাকিস্তান পন্থি জঙ্গিদের রোষানলে পড়বে। ঠিক যেমনটা
তারা এর আগে পড়েছিল।
এই দাবির আগে ভারত সরকার কাশ্মীরে হিন্দু অমরনাথ তীর্থ যাত্রীদের জন্য কিছু স্থায়ী শিবির
নির্মাণ করতে চেয়েছিল। তাতে প্রথম অনুমতি দেয় মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি। এরপর কাশ্মীর
জুড়ে বিক্ষোভ করে ফারুক আবদুল্লাহসহ পাকিস্তান পন্থি জঙ্গি জেকেএলফ ও হিজবুল মুজাহিদিনের
মত দলগুলো। পরিশেষে সরে আসে মেহবুবা মুফতি। এরপর বিজেপি সরকার পিডিপি থেকে সমর্থন প্রত্যাহার
করে নিলে কাশ্মীরে চলে গভর্নরের শাসন।
ভারতে বিজেপি সরকার কাশ্মীরের একটি স্থায়ী
সমাধান চায়। জম্মু ও লাদাক অঞ্চলের মানুষজনকে রক্ষায় কাশ্মীর থেকে এ দুটো অঞ্চল ভাগ
করে ফেলতে চাইছে তারা। কাশ্মীরের নেতাদের সুবিধাবাদী রাজনীতির শিকারে পরিণত হচ্ছে এই
অঞ্চলের লোকজন। এ কারণে মোদী সরকার এ দুটো অঞ্চলকে কাশ্মীর থেকে আলাদা করে শাসন করতে
চাইছে।
এজন্য
তারা অনুচ্ছেদ ৩৫ ও ৩৭০ দুটো বিলুপ্ত করার ঘোষণা করেছে। আর এই ঘোষণা এমন এক সময়ে আসলো
যখন কাশ্মীরের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের একে একে মেরে ফেলা হয়েছে। একসময় যারা ছিল পুরো
কাশ্মীর জুড়ে ত্রাস। তারা এখন প্রয়াত। কাশ্মীর আজ টুকরো হচ্ছে সেখানকার রাজনীতিবিদদের ভুল রাজনীতির কারণে। বহুবার তারা সুযোগ পেয়েছিল মুলধারায় ফিরে আসার।তবে সেটা তারা করেনি। এখন নিজেদের ভুলের খেসারত তারা দেবে নিজেদের অধিকার খর্ব করে।
No comments